হাজার বছর ধরে দূরবর্তী কোন স্থানে অতি দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বা বার্তা প্রেরণের একমাত্র উপায় ছিল ঘোড়সওয়ার দূত। পরবর্তীতে ১৮ শতকের শেষে ক্লদ শ্যাপে (Claude Chappe) নামে একজন বিজ্ঞানী ফ্রান্সে অপটিক্যাল টেলিগ্রাফ বা দৃশ্যমান সেমাফোর স্টেশনের (Semaphore Stations) একটি নেটওয়ার্ক চালু করেন, যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা ফ্রান্সে প্রায় ৬০ বছর ধরে চালু ছিলো।
এরপর যখন বৈদ্যুতিক বিপ্লব শুরু হলো তখন ক্যাবল বা তারের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সংকেত প্রেরণের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হতে থাকে। এক পর্যায়ে লন্ডনে ১৮৩৯ সালে বিজ্ঞানী চার্লস হুইটস্টোনের (Charles Wheatstone) আবিষ্কৃত ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিশ্বে প্রথম টেলিগ্রাফ সেবা চালু হয়। পাশাপাশি, ১৮৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্যামুয়েল মর্স (Samuel Morse) তার আবিষ্কৃত মর্স কোড ব্যবহার করে প্রথম টেলিগ্রাফ বার্তা প্রেরণ করেন।
বাণিজ্যিকভাবে টেলিগ্রাফ চালু হওয়ায়, দেশের অভ্যন্তরে যোগাযোগের জন্য টেলিগ্রাফের ক্যাবল বা তারগুলো দ্রুত বিভিন্ন দেশের প্রধান শহরগুলোকে সংযুক্ত করতে শুরু করে। ঠিক একইভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়। পরবর্তীতে ১৮৫০ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে গুট্টা পারচা দিয়ে প্রোটেক্টেড একটি সাবমেরিন টেলিগ্রাফ ক্যাবল স্থাপন করা হয়।
এরপর ১৮৫৮ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে টেলিগ্রাফ ক্যাবল স্থাপন করা হয় এবং অনেক দেশ এই ক্যাবলের মাধ্যমে সংযুক্ত হতে থাকে। কিন্তু ঐ সময় যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি বড় সমস্যা দেখা দেয়।
যখন টেলিগ্রাফ লাইন একটি দেশের সীমানা অতিক্রম করে অন্য দেশে প্রবেশ করত, তখন বার্তাগুলো সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হতো না। এর কারণ হলো প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব টেলিগ্রাফ প্রযুক্তি, সংকেত পদ্ধতি বা বার্তা প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা ব্যবহার করত। যেমন, একটি দেশে ব্যবহৃত কোড বা সংকেত পদ্ধতি অন্য দেশের পদ্ধতির সঙ্গে মিলত না। উদাহরণস্বরূপ, বার্তা প্রেরণের জন্য একটি দেশে মর্স কোড ব্যবহার করা হতে পারে, কিন্তু অন্য দেশে হয়তো মর্স কোডের ভিন্ন সংস্করণ বা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পদ্ধতি চালু ছিল।
আবার বার্তাগুলো একটি দেশের পদ্ধতি থেকে আরেক দেশের পদ্ধতিতে রূপান্তর বা অনুবাদ করতে হতো। যেমন, যদি একটি বার্তা ফ্রান্স থেকে জার্মানি পাঠানো হতো, ফ্রান্সের টেলিগ্রাফ সিস্টেম থেকে বার্তাটি জার্মান সিস্টেমের উপযোগী করে নিতে হতো।
এই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য ১৮৬৫ সালের ১৭ মে প্যারিসে প্রথম আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাফ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে প্রথম আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাফ কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়াও, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার জন্য একক মানদণ্ড তৈরি, অভিন্ন অপারেটিং নির্দেশিকা নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক ট্যারিফ ও হিসাবের জন্য সাধারণ নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ করার জন্য ২০ টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই কনভেনশন স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন, যার দায়িত্ব ছিলো চুক্তি সমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন ইত্যাদি বিষয় দেখভাল করা।
পরবর্তীতে টেলিফোন, বেতার যন্ত্র, টেলিভিশন আবিষ্কৃত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের কার্যক্ষেত্র বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং এর শাখা প্রশাখা বাড়তে থাকে। এছাড়াও, প্রায় সকল দেশেই টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বেতার ব্যবস্থা একই মন্ত্রনালয়ের অধীনে ন্যস্ত ছিলো। বিধায়, পরবর্তীতে সকল যোগাযোগ প্রযুক্তিকে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসার জন্য ১৯৩২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের বিদ্যমান কাঠামো পরিবর্তন এবং এর নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ০১ জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে নাম পরিবর্তন করে নতুন এক আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম হয় যার নাম আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন বা আইটিইউ। আইটিইউ এর সদর দপ্তর জেনেভা, সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত।
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সৃষ্টি হলে আইটিইউ এবং জাতিসংঘের মধ্য চুক্তি অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর জাতিসংঘ আইটিইউ কে এর বিশেষ এজেন্সী হিসেবে ঘোষণা করে, যা ১৯৪৯ সালের ০১ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হয়।
আইটিইউ এর গোড়াপত্তন যেহেতু ১৭ মে হয়েছিলো, এ কারণে প্রতি বছর ১৭ মে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
তথ্যসূত্র :
Overview of ITU’s History, ITU White Paper
George A. Codding, The International Telecommunications Union: 130 Years of Telecommunications Regulation, 23 Denv. J. Int’l L. & Pol’y 501 (1995)