সম্প্রতি বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা “বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)” একটি সার্কুলার প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, “৬ গিগাহার্জ ব্যান্ডের ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ তরঙ্গসীমাকে ওয়াই-ফাই, আইওটি, ওয়্যারলেস ল্যানসহ সেলুলার মোবাইল নেটওয়ার্কে Shared ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য জাতীয় তরঙ্গ বরাদ্দকরণ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব কমিশন কর্তৃক অনুমোদন করা হয়েছে।” এছাড়াও সার্কুলারটিতে আরও বলা হয়েছে যে, “বর্ণিত ব্যান্ডে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সার্ভিস দিতে হলে তরঙ্গ বরাদ্দ, রেডিও যন্ত্রপাতি আমদানী ও ব্যবহারের পূর্বে কমিশনের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে।”
অর্থাৎ, বিদ্যমান আনলাইসেন্সড ব্যান্ড ২.৪ এবং ৫ গিগাহার্জ তরঙ্গের পাশাপাশি এখন থেকে আনলাইসেন্সড ব্যান্ড হিসেবে ৬ গিগাহার্জ তরঙ্গের মাধ্যমে ওয়াইফাই, আইওটি, ওয়্যারলেস ল্যানসহ সেলুলার মোবাইল নেটওয়ার্ক সহ অন্যান্য পরিষেবা Shared ভিত্তিতে ব্যবহার করা যাবে। তবে বাণিজ্যিকভাবে সেবা দিতে হলে বিটিআরসি’র প্রচলিত নিয়ম অনুসরণপূর্বক পুর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য, Shared ভিত্তিতে তরঙ্গ ব্যবহার বলতে বুঝায় যে, বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক বাংলাদেশের স্থল সীমায় বর্ণিত তরঙ্গ বিনা খরচে ব্যবহার করতে পারবে, তবে তরঙ্গ ব্যবহারে যদি কোন প্রতিবন্ধকতা (Interference) সৃষ্টি হয়, তার জন্য বিটিআরসি’র নিকট কোন প্রতিকার চাইতে পারবে না।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে এই ব্যান্ডটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে আরও সহজ এবং দক্ষ করে তুলছে। এই ব্লগে আমরা এই তরঙ্গ ব্যান্ডের গুরুত্ব, এর বহুমুখী ব্যবহার এবং এর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
টেলিযোগাযোগ এবং বেতার প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলোর প্রয়োজনীয়তাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে, মিড ব্যান্ড স্পেকট্রাম বা তরঙ্গ। ১-৬ গিগাহার্জ তরঙ্গকে মিড ব্যান্ড তরঙ্গ বলা হয়ে থাকে। কাভারেজ এবং ক্যাপাসিটি’র জন্য বিশ্বব্যাপী ৫জি’র জন্য ৩.৫ গিগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গের যথেষ্ট কদর রয়েছে। এছাড়াও, আনলাইসেন্সড তরঙ্গ হিসেবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তরঙ্গ ব্যান্ড হলো ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ।
৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ তরঙ্গকে ৬ গিগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গ বলা হয়। এই তরঙ্গ ব্যান্ডকে মূলত দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
- নিম্নের অংশে ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ।
- উপরের অংশে ৬৪২৫-৭১২৫ মেগাহার্জ।
উল্লেখ্য যে, ৬৪২৫-৭১২৫ মেগাহার্জ লাইসেন্সড ব্যান্ড এবং ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ আনলাইসেন্সড ব্যান্ডের আওতাভুক্ত। উপর ও নিম্নের অংশ মিলিয়ে ৬ গিগাহার্জ ব্যান্ডে মোট তরঙ্গের পরিমাণ ১২০০ মেগাহার্জ।
নিম্নের চিত্রে মিড ব্যান্ড (Mid-Band) স্পেকট্রামের বন্টন দেখানো হলো:
আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ তরঙ্গের ব্যবহার
ক. Wi-Fi 6E: উচ্চ গতির ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির নতুন যুগ
Wi-Fi 6E হলো Wi-Fi প্রযুক্তির সর্বশেষ উন্নত সংস্করণ, যা ৬ গিগাহার্জ ব্যান্ডের অতিরিক্ত ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তি ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ ব্যান্ডে কাজ করে, যা আগের ২.৪ গিগাহার্জ এবং ৫ গিগাহার্জ ব্যান্ডের থেকে আলাদা।
উচ্চ গতি ও কম ল্যাটেন্সি: Wi-Fi 6E আরো দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে এবং ল্যাটেন্সি’র পরিমাণ কমিয়ে আনে। এর ফলে গেমিং, ভিডিও কনফারেন্সিং এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মতো ব্যান্ডউইথ-নির্ভর সেবাগুলোতে উন্নতি ঘটে।
ব্যান্ডউইথের প্রসার: Wi-Fi 6E এর মাধ্যমে বড় সংখ্যক ডিভাইস একই সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে, ফলে জনবহুল এলাকায় এর কনজেশন কমে যায় এবং উচ্চমানের সংযোগ পাওয়া যায়।
পূর্বের ২.৪ এবং ৫ গিগাহার্জ ব্যান্ডের ওয়াইফাই এর সাথে ৬ গিগাহার্জ ব্যান্ডের চ্যানেলের তুলনা:
ব্যান্ড | ২০ মেগাহার্জ চ্যানেল | ৪০ মেগাহার্জ চ্যানেল | ৮০ মেগাহার্জ চ্যানেল | ১৬০ মেগাহার্জ চ্যানেল |
---|---|---|---|---|
২.৪ গিগাহার্জ | ১১ | ২ | নাই | নাই |
৫ গিগাহার্জ | ৩৭ | ১৮ | ৯ | ৪ |
৬ গিগাহার্জ | ৫৯ | ২৯ | ১৪ | ৭ |
ভবিষ্যতপ্রসারী প্রযুক্তি: এই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডটি ভবিষ্যতের আরও উন্নত Wi-Fi প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করবে বলে ধারণা ক্রা হচ্ছে। বিশেষ করে স্মার্ট হোম, স্মার্ট সিটি এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) ডিভাইসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এই ব্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
খ. ফিক্সড মাইক্রোওয়েভ লিংক (Fixed Microwave Links)
৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ ব্যান্ডটি ফিক্সড মাইক্রোওয়েভ যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা যায়, যা মূলত পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট লিংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব লিংক ব্যবহার করা হয় বড় আকারের ডেটা স্থানান্তর এবং দীর্ঘ-দূরত্বে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। এটির বিশেষ কিছু ব্যবহার হলো:
মোবাইল নেটওয়ার্কের ব্যাকহল: মোবাইল টাওয়ার থেকে ডেটা নেটওয়ার্কের মূল অংশ পর্যন্ত পরিবহনের জন্য এই তরঙ্গ ব্যান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলে মোবাইল নেটওয়ার্কে সুষ্ঠুভাবে ডেটা ট্রান্সমিশন এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
দূরবর্তী এলাকায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডেটা ট্রান্সফার: যেখানে ফাইবার লাইন স্থাপন করা কঠিন বা ব্যয়বহুল, সেখানে অপটিক্যাল ফাইবারের বিকল্প হিসেবে এই ব্যান্ডটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ. স্যাটেলাইট যোগাযোগ এবং সি-ব্যান্ড
৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ ব্যান্ডটি সি-ব্যান্ড স্যাটেলাইট যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৪-৮ গিগাহার্জ তরঙ্গ ব্যান্ডকে সি-ব্যান্ড বলা হয়। বিশেষ করে, এই ব্যান্ডটি স্যাটেলাইট আপলিংক সেবার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা মহাকাশে ডেটা এবং সিগন্যাল পাঠানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। সি-ব্যান্ডের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তথ্য এবং সম্প্রচার সেবা প্রদান করা হয়। এর কিছু বিশেষ সুবিধা হলো:
বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন এবং রেডিও সম্প্রচার: সি-ব্যান্ড স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বড় পরিসরে তথ্য সম্প্রচার করা যায়, যা ইন্টারনেট পরিষেবার মতো অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে নির্ভরযোগ্য।
প্রত্যন্ত এলাকায় পরিষেবা: যেসব স্থানে স্থলভিত্তিক নেটওয়ার্কের নাগাল নেই, সেখানে স্যাটেলাইট ভিত্তিক সেবা প্রদানের জন্য এই ব্যান্ড অত্যন্ত কার্যকরী।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়: সি-ব্যান্ডের স্থিতিশীলতা এবং কম ইন্টারফেরেন্সের কারণে, এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জরুরি সেবা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হয়।
ঘ. ৫জি নেটওয়ার্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ
৫জি প্রযুক্তির দ্রুততা এবং দক্ষতার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে স্পেকট্রামের প্রয়োজন, বিশেষ করে যখন দ্রুত ডেটা স্থানান্তর এবং নিম্ন ল্যাটেন্সির মতো পরিষেবাগুলোর কথা আসে। ৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ ব্যান্ডটি ৫জি নেটওয়ার্কের জন্য ব্যবহারযোগ্য একটি সম্ভাব্য ব্যান্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর ভূমিকা হতে পারে:
ব্যাকহল এবং ফ্রন্টহল সংযোগের জন্য: ৫জি টাওয়ারগুলো থেকে মূল নেটওয়ার্ক পর্যন্ত ডেটা পরিবহনের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাকহল নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। এই ব্যান্ডটি তেমন ধরনের উচ্চ গতি সম্পন্ন সংযোগ প্রদান করতে সক্ষম।
উচ্চ গতি এবং বড় ডেটা স্থানান্তর: ৫জি নেটওয়ার্কে প্রচুর পরিমাণ ডেটা দ্রুত গতিতে পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত স্পেকট্রামের প্রয়োজন, এবং এই ব্যান্ডটি তা সরবরাহ করতে পারে।
আরও পড়ুন…
৫জি কীভাবে বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রা
৫৯২৫-৬৪২৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ ব্যান্ডটি বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়, যার ফলে ইন্টারফেরেন্স ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এই ব্যান্ডটি Wi-Fi, স্যাটেলাইট, ৫জি নেটওয়ার্ক এবং ফিক্সড মাইক্রোওয়েভ লিংকের মতো বিভিন্ন পরিষেবায় ব্যবহৃত হবে, সঠিক স্পেকট্রাম শেয়ারিং এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বিভিন্ন পরিষেবার মধ্যে ইন্টারফেরেন্স ঘটতে পারে, যা পরিষেবার মান কমিয়ে দিতে পারে।